শাহজাদপুরের অনেক ঐতিহ্যের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো এখানকার অসাধারণ বৈশিষ্ট্য মণ্ডিত বাথান ভূমি- অর্থাৎ বিশাল সুবিস্তৃত গো-চারণ ভূমি। বাংলাদেশে আর কোথাও এতো বড় এতো উর্বর গো-চারণ ভূমি বোধ হয় নেই। এর আয়তন প্রায় ১,২০০ (বারশো) একর।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিল 'চলন বিল' এর দক্ষিণ-পূর্বাংশ এই ঐতিহ্যবাহী বাথান ভূমি। এটি প্রতি বছর আষাঢ়ের শেষ দিকে পনিতে ডুবে যায় এবং আশ্বিন মাসে ধীরে ধীরে জেগে উঠে। প্রায় তিন মাসকাল বন্যার পানির নিচে ডুবে থাকে। ফলে পলি পড়ে অসাধারণ উর্বর হয় প্রতি বছর এ বাথান ভূমি। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথেই বাথানি কৃষকরা কাদা মাটির উপর মাসকালাই ও খেসাড়ির বীজ ছিটিয়ে দেয়। নরম নতুন পলি মাটিতে মাসকালাইগুলো দ্রুত বেড়ে উঠে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠকে সবুজ শ্যামলিম সৌন্দর্যে অপূর্ব করে তোলে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু সবুজ সৌন্দর্যের আপরিমিত প্রাণপ্রবাহ।
পৌষমাস থেকে এখানে আসে গরুর পাল। নানা রং চেহারার অগুনতি গরু মহানন্দে লেজ নেড়ে নেড়ে কচি কচি মাসকলাইয়ের গাছগুলো দাঁতে কেটে কেটে খেতে থাকে পরম তৃপ্তিতে।বক, শালিক, ফিঙে, দোয়েলসহ নানা জাতের পাখি গরুগুলোর চারপাশে উড়তে থাকে। কখনো বা গরুর পিঠের উপর বসে দোল খায়। গরুর গায়ের আটালি বা অন্য কোনো পোকা ধরে খায়। পাখিগুলো এ অপূর্ব দৃশ্যে সৌর্ন্দযের এক নতুন মাত্রা যোগ করে।
মেঘমুক্ত জোছনা প্লাবিত রাতের আকাশে যেমন ছোট বড় অসংখ্য তারা জ্বলে, দূর থেকে তাকালে এই গো-চারণ মাঠে তেমনি হাজার হাজার নানা রঙের গরু চরতে দেখা যায়। না দেখলে সে দৃশ্যের সৌন্দর্য এবং আনন্দ বোঝানো অসম্ভব প্রায়।
এই ঐতিহাসিক বাথান ভূমি সৃষ্টির একটা সুন্দর ইতিহাস রয়েছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ তখন জমিদারি তত্ত্বধানের কাজে শাহজাদপুরে আসতেন এবং এখানে অবস্থান করতেন। কবি শাহজাদপুরের প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং বিচিত্র জীবনপ্রবাহের সৌন্দর্যে আনন্দ বিস্ময়ে অভিভূত হন। সৃষ্টি করেন অসাধারণ সব সাহিত্যকর্ম---ভালোবাসেন এখানকার মানুষকে। শাহজাদপুরে এসে রবীন্দ্রনাথ অপার আনন্দ অনুভব করতেন। এখানকার ঘোষদের দুধ, ঘি,দধি রবীন্দ্রনাথ খুব পছন্দ করতেন। পোতাজিয়া ও রাউতারার ঘোষদের কাছ থেকে খাঁটি গাওয়া ঘি সংগ্রহ করে তাঁর জোড়াসাঁকোর বাড়িতে পাঠাতেন । কবির স্ত্রী মৃণালীনিদেবীর কাছে শাহজাদপুর থেকে লেখা একটা চিঠি থেকে এ কথা জানা যায়। একদিন রাউতারার এক ঘোষ কবিকে বললো, "আর বোধ হয় আপনাদের ভালো দুধ, ঘি খাওয়াতে পারবো না বাবু।" রবীন্দ্রনাথ এর কারণ জানতে চাইলে ঘোষ জানালো, "গরু চরাবার মাঠ নেই- গরুকে ভালো ঘাস না খাওয়ালে ভালো দুধ ঘি হবে কী করে?" এ কথা শুনে কবি রাউতারার পাশে বুড়িপৌতাজিয়া ও রামকান্তপুর মৌজার বিস্তৃত ভূখণ্ড গোচারণের জন্য লাখেরাজ হিসেবে দান করে দেন। সেই থেকে এই বিশাল এলাকা বাথান ভূমি নামে পরিচিত হয়ে আছে। উল্লেখ্য, কৃষকেরা মাঠের ফসল পাহারা দেওয়া এবং পশু পালনের জন্য অস্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করেন। এর নামই বাথান। শুধু যে গোচারণের জন্য জমি দিয়েছেন তা নয়, ভালো উন্নত শাহিওয়াল জাতের ষাঁড় এনে গাভি প্রজননের মাধ্যমে উন্নত গো-সম্পদ সৃষ্টির ব্যবস্থা করেছিলেন।
বাংলাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং উন্নত দুগ্ধশিল্প গড়ে উঠেছে শাহজাদপুরে। এরই ধারাবাহিকতায় শাহজাদপুরে তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম দুগ্ধপ্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা 'মিল্ক ভিটা'। আর এর মূলে রয়েছে এখানকার ঐতিহ্যবাহী বাথানভূমির আবদান। শাহজাদপুর একটি পর্যটন কেন্দ্র হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এর জন্য যে সব বিষয় রয়েছে তার মধ্যে এই বিখ্যাত বাথান গুলি অন্যতম আকর্ষণীয় একটি বিষয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস